বন্যাকবলিত এলাকায় বাড়ছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ

দেশে বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। চলতি মৌসুমে তিন সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা বন্যার মুখোমুখি দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের জনগণ। ১৮ জেলার নিম্নাঞ্চলে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে।

সোমবারও (২০ জুলাই) জামালপুরে বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে হাটবাজার ও রাস্তাঘাটসহ নতুন নতুন এলাকা। অন্যদিকে, বানের পানিতে ভাসছে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রাম। এছাড়া, টাঙ্গাইলসহ বন্যাকবলিত বেশিরভাগ এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকট। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের।

জামালপুর: জামালপুরের হারগিলা এলাকার রাস্তা গড়িয়ে লোকালয়ে ঢুকছে পানি। দীর্ঘ হচ্ছে দুর্ভোগের চিত্র। পানি ঠেলে সড়কে চলছে ৩ চাকার ছোট যানবাহন। কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে সরিষাবাড়ি বাস টার্মিনাল। বন্ধ রয়েছে সরিষাবাড়ি-জামালপুর আঞ্চলিক সড়কের যান চলাচলও। জেলার ৭ উপজেলার ৬শ’ ২৫টি গ্রাম এখনো পানির নিচে।

টাঙ্গাইল: এখনো তীব্র স্রোতে প্লাবিত হচ্ছে জনপদ। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দদাসী গ্রামসহ আশপাশের ৬টি উপজেলার একই চিত্র। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২শ’ গ্রামের ২ লাখের বেশি মানুষ। গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধপানির সংকটও।

মুন্সিগঞ্জ: সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বন্যায় ভিটেছাড়া অসংখ্য মানুষ।

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ব্রাহ্মণগাঁওসহ অন্তত ১০ গ্রাম ভাসছে পানিতে। রাউৎগাঁও-পাইকারা সড়কের ছোট্ট একটু ঊচু জায়গায় রাখা হয়েছে বন্যা কবলিতদের কয়েকশ গবাদিপশু। দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের চরম সংকটও।

গাইবান্ধা: ভেলায় চড়ে বিশুদ্ধ পানির খোঁজে বের হয়েছেন অনেকে।

গাইবান্ধায় বৃষ্টিতে বেড়েছে দুর্ভোগ। বাড়িঘরে পানি উঠে পড়ায় রান্না-খাওয়া নিয়ে বিপাকে সদর উপজেলাসহ ৩ উপজেলার চর ও দ্বীপচরের কয়েক হাজার মানুষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, ৩০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত উপদ্রুত এলাকায় ডায়রিয়া, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, শ্বাসনালীর প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ২৪ জন।

এ তিন সপ্তাহে পানিতে ডুবে, ডায়রিয়ায়, সাপের কামড়ে ও বজ্রপাতে ৬৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নথিভুক্ত হয়েছে।

নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নিয়ামুল হক বলেন, দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ডায়রিয়া রোগী। সামনে আরও হয়ত বাড়বে।

তিনি জানা, দুর্গত এলাকাগুলোতে তাদের মেডিকেল টিম কাজ করছে। বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও অন্যান্য ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, মহামারীকালে এ বন্যায় দুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্য বিধির সচেতনতায় যাতে ঢিল না পড়ে, সে বিষয়ে তারা সতর্ক।

বন্যা পরিস্থিতি:

দেশের নদ-নদীগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩২টি স্টেশনে পানি কমেছে; ৬৬টি পয়েন্টে বেড়েছে। এর মধ্যে ১৪টি নদীর ২৪টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছিল। তিনটি পয়েন্টে পানির উচ্চতা অপরিবর্তিত ছিল।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ১০ দিনের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানির সমতল কিছুটা কমে সোমবার স্থিতিশীল থাকতে পারে।

তাতে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।

তবে মঙ্গলবারের পর থেকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি আবার বাড়তে পারে এবং ২৭ জুলাই নাগাদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তাতে ওই সাত জেলার বন্যা পরিস্থিতি আবার অবনতির দিকে যেতে পারে। এই বন্যা চলতে পারে জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত।

মানিকগঞ্জের জাগির স্টেশনে ধলেশ্বরী নদীর পানি সমতল আগামী ৫ দিনের মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আপার মেঘনা অববাহিকার নদীগুলোর পানি কমার প্রবণতা রোববারও অব্যাহত ছিল।

রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পয়েন্ট, মুন্সিগঞ্জ জেলার ভাগ্যকুল পয়েন্ট এবং শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর পয়েন্টে পানির সমতল আগামী ৪৮ ঘণ্টা স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং তারপর আবার বাড়তে পারে। তাতে এসব জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি আগামী ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানির সমতলও আগামী কয়েক দিনে বাড়তে পারে। ঢাকার ডেমরা পয়েন্টে বালু নদী, মিরপুর পয়েন্টে তুরাগ নদী এবং রেকাবি বাজার পয়েন্টে ধলেশ্বরী নদী আগামী ৭ দিনের মধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উচ্চতাও আগামী ৫ দিনের মধ্যে বিপদসীমা পেরিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

আপনি আরও পড়তে পারেন